কুরআন মজীদ ও সহীহ হাদীসের আলোকে রমাযানুল মুবারক


হিজরীবর্ষের নবম মাসটির নাম রমাযানুল মুবারক। এ মাসের মর্যাদা ও মাহাত্ম্য বলারঅপেক্ষা রাখে না। এ মাস আল্লাহ তাআলার অধিক থেকে অধিকতর নৈকট্য লাভেরউত্তম সময়, পরকালীন পাথেয় অর্জনের উৎকৃষ্ট মৌসুম। ইবাদত-বন্দেগী, যিকির-আযকার এবং তাযকিয়া ও আত্মশুদ্ধির ভরা বসন্ত। মুমিন বান্দার জন্য রমযান মাসআল্লাহ তাআলার অনেক বড় নেয়ামত। তিনি এই মাসের প্রতিটি দিবস-রজনীতে দানকরেছেন মুষলধারা বৃষ্টির মত অশেষ খায়ের-বরকত এবং অফুরন্ত কল্যাণ। মুমিনেরকর্তব্য, এই মহা নেয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞ ও আনন্দিত হওয়া। ইরশাদ হয়েছে-

قُلْ بِفَضْلِ اللَّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُوا هُوَ خَيْرٌ مِمَّا يَجْمَعُونَ

 (তরজমা) (হে নবী) আপনি বলুন! এটা আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর রহমতেই হয়েছে।সুতরাং এতে তারা যেন আনন্দিত হয়। তারা যা কিছু সঞ্চয় করে, এটা তার চেয়েউত্তম।-সূরা ইউনুস (১০)-৫৮

এ মাসে বান্দা পার্থিব সকল চাহিদা বিসর্জন দিয়ে আল্লাহর দয়া ও রহমত লাভ করবে,অতীতের সকল পাপাচার থেকে ক্ষমা চেয়ে নতুনভাবে ঈমানী জিন্দেগীর উত্তাপ গ্রহণকরবে, তাকওয়ার অনুশীলনের মাধ্যমে পুরো বছরের ইবাদত ও ইতাআতের শক্তিসঞ্চয় করবে, চিন্তা-চেতনা ও কর্ম-সাধনায় আল্লাহর আনুগত্যে নিজেকে সমর্পিতকরবে-এই হচ্ছে মুমিনের আনন্দ।

আল্লাহ তাআলা এই পবিত্র মাসকে যেসব গুণ ও মর্যাদা দ্বারা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছেন,যত রহমত, বরকত এবং দয়া ও অনুগ্রহ দ্বারা একে মহিমান্বিত করেছেন, এ মাসেরনেক আমলগুলোর যত সওয়াব ও প্রতিদান নির্ধারিত করেছেন তার হিসাব-নিকাশমানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তবুও কুরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতে এবং হাদীসশরীফের বিস্তৃত বর্ণনায় যে গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট বর্ণিত হয়েছে, তার কিছু দৃষ্টান্ত এখানেউল্লেখ করার চেষ্টা করব। আল্লাহ তাআলা সবাইকে উপকৃত করুন। আমীন।

১. সিয়াম ও কিয়ামের মাস

মুসলিম উম্মাহর নিকট রমযান মাসের আগমন ঘটে প্রধানত রোযা ও তারাবীহ’র বার্তানিয়ে। এটি রমযান মাসের বিশেষ আমল। তাই প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য, পূর্ণ নিষ্ঠা ও
আন্তরিকতার সাথে এ দুই বিষয়ে যত্নবান হওয়া। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

হে মুমিনগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিলতোমাদের পূর্ববর্তীদের প্রতি; যাতে তোমরা তাক্বওয়া অবলম্বনকারী (মুত্তাকী) হতেপার।-সূরা বাকারা (২) ১৮৩- অন্য আয়াতে ইরশাদ করেছেন,

فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ وَمَنْ كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ

সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস (রমযান) পাবে, সে যেন অবশ্যই তার রোযারাখে। আর তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অসুস্থ হয় বা সফরে থাকে, তবে অন্য সময় সেসমান সংখ্যা পূরণ করবে।-সূরা বাকারা-১৮৫

হযরত আবু হুরায়রা রা বলেন,

لما حضر رمضان، قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : قد جاءكم رمضان، شهر مبارك، افترض الله عليكم صيامه، تفتح فيه أبواب الجنة، وتغلق فيه أبواب الجحيم، وتغل فيه الشياطين، فيه ليلة خير من ألف شهر، من حرم خيرها فقد حرم. قال الشيخ شعيب الارنؤوط فى تعليقه على المسند : هذا حديث صحيح، وإسناد رجاله رجال الشيخين.

যখন রমযান মাসের আগন ঘটলো, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামইরশাদ করলেন, তোমাদের নিকট বরকতময় মাস রমযান এসেছে। আল্লাহ তাআলাতোমাদের জন্য এ মাসের রোযা ফরয করেছেন। এ মাসে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলেদেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর শয়তানদেরকেশিকলে বন্দী করা হয়। এ মাসে এমন একটি রাত আছে, যা হাজার মাসের চেয়েওউত্তম। যে এর কল্যান থেকে বঞ্চিত হল, সে তো প্রকৃতপক্ষেই বঞ্চিত।-মুসনাদেআহমদ, হাদীস-৭১৪৮ সুনানে নাসায়ী-হাদীস-২৪১৬, মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক,হাদীস ৮৩৮৩ মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদীস ৮৯৫৯

২. কুরআন নাযিলের মাস

রমাযানুল মুবারকের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হল তা কুরআন নাযিলের মাস। এই পবিত্রমাসেই আল্লাহ তাআলা পূর্ণ কুরআন মজীদ লওহে মাহফুয থেকে প্রথম আসমানেঅবতীর্ণ করেন। অতপর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটকুরআনের সর্বপ্রথম অহীও এ মাসেই নাযিল হয়। রমযান মাসের অন্য কোনো ফযীলতযদি উল্লেখিত না হত, তবে এই এক ফযীলতই তার মর্যাদা ও বিশেষত্বের জন্য যথেষ্টহতো। রমযান মাসের পরিচয় ও গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথমএই বৈশিষ্ট্যের কথাই উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-

شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآَنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ

(তরজমা) রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল হয়েছে, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবংসুপথ প্রাপ্তির সুস্পষ্ট পথনির্দেশ আর হক্ব-বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী। সুতরাংতোমাদের যে কেউ এ মাস পাবে সে যেন অবশ্যই এর রোযা রাখে।-সূরা বাকারা (২) :১৮৫

শুধু কুরআন মজীদ নয়, হযরত ইবরাহীম আ. এর সহীফা, তাওরাত, যবুর, ইঞ্জিলসহসকল আসমানী কিতাব এ মাসে অবতীর্ণ হয়েছে। তাবারানী বর্ণিত একটি সহীহ হাদীসেএই বৈশিষ্ট্যও উল্লেখিত হয়েছে।

৩. মুসলমানদের জন্য সর্বোত্তম মাস।

হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদকরেছেন,

ما اتى على المسلمين شهر خير لهم من رمضان ولا اتى على المنافقين شهر شرلهم من رمضان، وذلك لمايعد المؤمنون فيه من القوة للعبادة وما يعد فيه المنافقون من عفلات الناس وعوراتهم هو غنم المؤمن يغتنمهالفاجر.

قال الشيخ احمد شاكر فى تعليقه على المسند (8350) اسناده صحيح وفى (8856) اسناده حسن لغيره.

আল্লাহ তাআলার কসম! মুসলমানদের জন্য রমযানের চেয়ে উত্তম কোনো মাসআসেনি এবং মুনাফিকদের জন্য রমযান মাসের চেয়ে অধিক ক্ষতির মাসও আরআসেনি। কেননা মুমিনগণ এ মাসে (গোটা বছরের জন্য) ইবাদতের শক্তি ও পাথেয়সংগ্রহ করে। আর মুনাফিকরা তাতে মানুষের উদাসীনতা ও দোষত্রুটি অন্বেষণ করে। এমাস মুমিনের জন্য গনীমত আর মুনাফিকের জন্য ক্ষতির কারণ।-মুসনাদে আহমদ,হাদীস ৮৩৬৮, মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদীস-৮৯৬৮, সহীহ ইবনে খুযাইমা,হাদীস-১৮৮৪, তাবারানী হাদীস-৯০০৪, বাইহাকী শুয়াবুল ঈমান, হাদীস-৩৩৩৫

৪. রহমতের মাস। এ মাসে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয় এবংজাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। আর শয়তানদেরকে শৃঙ্খলাবদ্ধকরা হয়।

ইতিপূর্বে উল্লেখিত একটি হাদীসে এ বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। এ ছাড়া আরো হাদীসে তাআছে। হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামইরশাদ করেছেন-

إذا جاء رمضان فتحت أبواب الجنة، وغلقت أبواب النار، وصفدت الشياطين.

যখন রমযান মাসের আগমন ঘটে, তখন জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবংজাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর শয়তানদেরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করাহয়।-সহীহ বুখারী, হাদীস-১৮৯৮, সহীহ মুসলিম, হাদীস-১০৭৯ (১), মুসনাদে আহমদহাদীস-৮৬৮৪, সুনানে দারেমী, হাদীস-১৭৭৫

হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদকরেছেন-

إذا كان رمضان فتحت أبواب الرحمة، وغلقت أبواب جهنم، وسلسلت الشياطين.

وفي رواية البخاري : إذا دخل شهر رمضان، فتحت أبواب السماء ...

রমযান মাস শুরু হলেই রহমতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলোবন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানদেরকে শিকলে আবদ্ধ করা হয়।-সহীহ মুসলিমহাদীস-১০৭৯-২

সহীহ বুখারী’র বর্ণনায় রয়েছে, রমযান আরম্ভ হলে আসমানের দরজাসমূহ খুলেদেওয়া হয়, ...। হাদীস-১৮৯৯

মুহাদ্দিসীনে কেরাম বলেন, মুমিন বান্দাগণ যাতে রমযান মাসের অতি মূল্যবান ওবরকতপূর্ণ সময় নেক কাজে ব্যয় করতে পারে এবং মুনাফিকদের মত খায়ের ওবরকত থেকে বঞ্চিত না থাকে, তাই আল্লাহ তাআলা এ মাসের শুরু থেকেই সৃষ্টিজগতেএমন আবহ সৃষ্টি করেন, যা পুরো পরিবেশকেই রহমত-বরকত দ্বারা আচ্ছাদিত করেদেয় এবং মুমিনদেরকে ইবাদত-বন্দেগী ও নেক আমলের উৎসাহ-উদ্দীপনা জোগাবে।তাদের পূণ্য ও প্রতিদানের সুসংবাদ দিতে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবংপাপাচার ও খারাপ কাজ হতে বিরত রাখতে জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়াহয়। সব ধরনের ফিতনা-ফাসাদ ও অনিষ্ট হতে রক্ষা করতে কুমন্ত্রণাদাতা দুষ্ট জ্বিন ওশয়তানদেরকে শিকল লাগিয়ে আবদ্ধ করা হয়। তারপর কল্যাণের পথে অগ্রগামীহওয়ার ও অন্যায় থেকে নিবৃত্ত থাকার আহবান জানানো হয়। যেমন আবু হুরায়রা রা.থেকেই বর্ণিত এক হাদীসে আছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামবলেছেন-

إذا كان أول ليلة من شهر رمضان صفدت الشياطين ومردة الجن، وغلقت أبواب النار، فلم يفتح منها باب،وفتحت أبواب الجنة، فلم يغلق منها باب، وينادي منادٍ : يا باغي الخير! أقبل، ويا باغي الشر! اقصر، ولله عتقاءمن النار، وذلك كل ليلة.

যখন রমযান মাসের প্রথম রাতের আগমন ঘটে, তখন দুষ্ট জ্বিন ও শয়তানদেরশৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়, তার একটি দরজাওখোলা হয় না এবং জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়, তার একটি দরজাও বন্ধ করাহয় না। আর একজন ঘোষক ঘোষণা করতে থাকে-হে কল্যাণের প্রত্যাশী! অগ্রসর হও,হে অকল্যাণের প্রার্থী! থেমে যাও। আর আল্লাহ তাআলা এ মাসের প্রতি রাতে অসংখ্যজাহান্নামীকে মুক্তি দান করেন।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস ১৮৭৯৪, ৫; বাইহাকী শুয়াবুলঈমান, হাদীস-৩৬০১, সুনানে তিরমিযী, হাদীস-৬৮২, সুনানে ইবনে মাজাহ,হাদীস-১৬৪২ মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস-১৫৭২ মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা,হাদীস-৮৯৬০

৫. জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের মাস এবং দুআ কবুলের মাস

পূর্বের হাদীসেই বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ তাআলা এ মাসের প্রতি রাত্রে অসংখ্যজাহান্নামীকে মুক্তি দান করেন। সুতরাং আমাদের কর্তব্য, বেশি বেশি নেক আমল এবংতাওবা-ইস্তিগফারের মাধ্যমে নিজেদেরকে এই শাহী ফরমানের অন্তর্ভুক্ত করা।

এ প্রসঙ্গে অন্য হাদীসে হযরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর রাসূলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

إن لله عند كل فطر عتقاء، وذلك في كل ليلة.

وقال البوصيري : رجال إسناده ثقات

অবশ্যই আল্লাহ তাআলা রমযান মাসে প্রতি ইফতারের সময় অসংখ্য ব্যক্তিকেজাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন। প্রতি রাতেই তা হয়ে থাকে।-সুনানে ইবনে  মাজাহ,হাদীস-১৬৪৩, মুসনাদে আহমদ, হাদীস-২২২০২, তবারানী হাদীস-৮০৮৮.বায়হাকী-৩৬০৫

হযরত আবু হুরায়রা রা. অথবা আবু সাঈদ খুদরী রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

إن لله عتقاء في كل يوم وليلة (يعني في رمضان) لكل عبد منهم دعوة مستجابة.

قال الشيخ شعيب الارنؤوط : وإسناده صحيح على شرط الشيخين.

অবশ্যই আল্লাহ তাআলা রমযান মাসের প্রত্যেক দিবস ও রাত্রিতে অসংখ্য ব্যক্তিকেজাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন। এবং প্রত্যেক মুমিন বান্দার একটি করে দুআ কবুলকরেন। -মুসনাদে আহমদ হাদীস ৭৪৫০, মুসনাদে বাযযার, হাদীস-৯৬২

হযরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদকরেছেন-

إن لله في كل يوم وليلة عتقاء من النار في شهر رمضان، وإن لكل مسلم دعوة يدعو بها فيستجاب له.

وقال الهيثمى فى المجمع : رواه البزار، ورجاله ثقات.

রমযান মাসের প্রতিটি দিবস ও রজনীতে আল্লাহ তাআলা অসংখ্য ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন। প্রত্যেক মুসলিমের একটি দুআ, যা সে করে, কবুল করা হয়।-মুসনাদে বায্যার, হাদীস ৩১৪১, মাযমাউয যাওয়াইদ, ১৭২১৫

৬. দানশীলতার মাস

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন,

كان رسول الله صلى الله عيله وسلم أجود الناس، وكان أجود ما يكون في رمضان، حين يلقاه جبريل، وكانيلقاه في كل ليلة من رمضان فيدارسه القرآن، فلرسول الله صلى الله عليه وسلم أجود بالخير من الريح المرسلة.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানুষের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা। তাঁরদানশীলতা (অন্য সময় হতে) অধিকতর বৃদ্ধি পেত রমযান মাসে, যখন জিব্রীল আ.তার সাথে সাক্ষাৎ করতেন। জিব্রীল আ. রমযানের প্রতি রাত্রে আগমন করতেন এবংতাঁরা পরস্পর  কুরআন শুনাতেন। তো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামতখন কল্যাণবাহী বায়ুর চেয়েও অধিক দানশীল।-সহীহ বুখারী, হাদীস-৬, সহীহ মুসলিমহাদীস-২৩০৮, মুসনাদে আহমদ, ২৬১৬

হযরত যায়েদ ইবনে খালেদ আলজুহানী রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

من فطر صائما كان له مثل أجره، غير أنه لا ينقص من أجر الصائم شيئًا.

قال الترمذى : هذا حديث حسن صحيح.

যে ব্যক্তি কোনো রোযাদারকে ইফতার করাবে, সে তার (রোযাদারের) অনুরূপ প্রতিদানলাভ করবে। তবে রোযাদারের প্রতিদান হতে বিন্দুমাত্রও হ্রাস করা হবে না।-সুনানেতিরমিযী, হাদীস-৮০৭, মুসনাদে আহমদ, হাদীস-১৭০৩৩, সুনানে ইবনে মাজাহ,হাদীস-১৭৪৬, সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস-৩৪২৯, সহীহ ইবনে খুযাইমা,হাদীস-২০৬৪

হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-

من فطر صائما أطعمه وسقاه كان له مثل أجره.

رواه عبد الرزاق في مصنفه : وهو في حكم المرفوع، فمثله لا يعرف بالرأي،

যে ব্যক্তি কোনো রোযাদারকে পানাহার করিয়ে ইফতার করাবে, সে তার অনুরূপসওয়াব লাভ করবে। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস-৭৯০৬

৭. আমলের সওয়াব বহুগুণ বৃদ্ধির মাস

রমযান মাসের আরেকটি বৈশিষ্ট্য এই যে, এ মাস মুমিনের নেক আমলের প্রতিদানবৃদ্ধির মাস এবং আখেরাতের সওদা করার শ্রেষ্ঠ সময়। দুনিয়ার ব্যবসায়ীদের যেমনবিশেষ বিশেষ মৌসুম থাকে, যখন খুব জমজমাট ব্যবসা হয় এবং বছরের অন্য সময়েরতুলনায় আয়-উপার্জন ও মুনাফা বেশি হয়, তেমনি আখেরাতের ব্যবসায়ীদের জন্যব্যবসার শ্রেষ্ঠ মওসুম হচ্ছে রমযান মাস। এ মাসে আমলের দ্বারা অনেক বেশি মুনাফালাভ করা যায়। এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে-

عن ابن عباس رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لامرأة من الأنصار، سماها ابن عباسفنسيت اسمها (وفي الرواية الأخرى : يقال لها أم سنان)، ما منعك أن تحجي معنا؟ قالت : لم يكن لنا إلا ناضحان،فحج أبو ولدها وابنها على ناضح وترك لنا ناضحا ننضح عليه، قال : إذا جاء رمضان فاعتمري، فإن عمرة فيهتعدل حجة.

وفي رواية أخرى لمسلم : فعمرة في رمضان تقضي حجة أو حجة معي.

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএক আনসারী মহিলাকে বললেন, বর্ণনাকারী বলেন, তার নাম ইবনে আববাস রা.উল্লেখ করেছিলেন কিন্তু আমি তা ভুলে গিয়েছি-(অন্য বর্ণনায় তার নাম উম্মে সিনানউল্লেখ করা হয়েছে) তুমি কেন আমাদের সাথে হজ্ব করতে যাওনি? তিনি বললেন,আমাদের পানি বহনকারী দুটি মাত্র উট রয়েছে। একটিতে আমার ছেলের বাবা (স্বামী)ও তাঁর ছেলে হজ্ব করতে গিয়েছেন, অন্যটি পানি বহনের জন্য আমাদের কাছে রেখেগিয়েছেন। তিনি বলেন, রমযান মাস এলে তুমি উমরা করবে। কেননা এ মাসের উমরাএকটি হজ্বের সমতুল্য। সহীহ মুসলিমের অন্য বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, রমযান মাসের উমরা একটি হজ্বের সমতুল্য।অথবা বলেছেন, আমার সাথে একটি হজ্বের সমতুল্য (সওয়াবের হিসাবে)।-সহীহবুখারী, হাদীস, ১৭৮২, সহীহ মুসলিম-১২৫৬, মুসনাদে আহমদ, হাদীস-২০২৫

হযরত উম্মে মাকিল রা. হতে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদকরেছেন-

عمرة في رمضان تعدل حجة.

رواه الترمذي في سننه، وقال : حديث أم معقل حديث حسن غريب، ورواه أبو داود، وفي رواية أحمد عن أممعقل الأسدية، أنها قالت : يا رسول الله صلى الله عليه وسلم! إني أريد الحج وجملي أَعْجَفُ، فما تأمرني، قال :اعتمري في رمضان، فإن عمرة في رمضان تعدل حجة.

রমযান মাসে উমরা হজ্বের সমতুল্য। -সুনানে তিরমিযী, হাদীস-৯৩৯, সুনানে আবুদাউদ, হাদীস ১৯৮৬।

অন্য বর্ণনায় রয়েছে, উম্মে মাকিল রা. বলেন-ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি তো হজ্ব করতেইচ্ছুক। কিন্তু আমার উটটি দুর্বল। তিনি বললেন, তুমি রমযান মাসে উমরা করো।কেননা রমযান মাসে উমরা (সওয়াব হিসেবে) হজ্বের সমতুল্য। মুসনাদে আহমদ,হাদীস ২৭২৮৫

৮. পাপ মোচন ও গুনাহ থেকে ক্ষমা লাভের মাস

হযরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামবলতেন-

الصلوات الخمس والجمعة إلى الجمعة ورمضان إلى رمضان مكفرات ما بينهن، إذا اجتنب الكبائر.

পাঁচ ওয়াক্ত নামায, এক জুমুআ থেকে আরেক জুমুআ এবং এক রমযান থেকে আরেকরমযান মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহসমূহকে মুছে দেয় যদি সে কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচেথাকে।-সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৩৩ (৩)

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, রমযান মাস হল মাগফিরাত লাভের মাস, যে মাসেসকলের জন্য ক্ষমার দুয়ার উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ক্ষমা লাভের এমন সূবর্ণ সুযোগপেয়ে যে ব্যক্তি নিজের পাপসমূহ ক্ষমা করাতে পারে না সে সত্যিই ক্ষতিগ্রস্ত। হাদীসশরীফে তার জন্য বদ দুআ করা হয়েছে।

হযরত কা’ব ইবনে উজরা রা. হতে ব©র্ণত, তিনি বলেন-

قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : احضروا المنبر، فحضرنا، فلما ارتقى درجة قال آمين، فلما ارتقىالدرجة الثانية قال آمين، فلما ارتقى الدرجة الثالثة قال آمين، فلما نزل، قلنا : يا رسول الله! لقد سمعنا منك اليوم ماكنا نسمعه، قال : إن جبريل عرض لي فقال : بعد من أدرك رمضان فلم يغفر له، قلت : أمين، فلما رقيت الثانية،قال : بعد من ذكرت عنده فلم يصل عليك، قلت : آمين، فلما رقيت الثالثة، قال : بعد من أدرك أبويه الكبير أوأحدهما فلم يدخلا الجنة، قلت : آمين.

رواه الحاكم، وقال : صحيح الإسناد، واورده الهيثمى فى المجمع وقال : رواه الطبرانى ورجاله ثقات.

একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে বললেন, তোমরামিম্বরের নিকট সমবেত হও। আমরা সকলেই তথায় উপস্থিত হলাম। যখন তিনিমিম্বরের প্রথম সিড়িতে পা রাখলেন, তখন বললেন, আমীন, যখন দ্বিতীয় সিঁড়িতে পারাখলেন বললেন, আমীন, যখন তিনি তৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখলেন বললেন, আমীন।

হযরত কা’ব ইবনে উজরা রা. বলেন, যখন তিনি (মিম্বর থেকে) অবতরণ করলেন,আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আজ আমরা (মিম্বরে উঠার সময়)আপনাকে এমন কিছু কথা বলতে শুনেছি, যা ইতিপূর্বে কখনো শুনিনি। উত্তরে তিনিবললেন, জিব্রীল আ. আমার নিকট আগমন করেছিলেন, যখন আমি প্রথম সিড়িতে পারাখলাম, তখন তিনি বললেন, ধ্বংস হোক ঐ ব্যক্তি যে রমযান মাস পেল, তবুও তারগুনাহ মাফ হল না। আমি বললাম, আমীন। যখন দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখলাম তখনবললেন, ধ্বংস হোক ঐ ব্যক্তি যার নিকট আপনার নাম উচ্চারিত হল অথচ সেআপনার প্রতি দরূদ পড়ল না। আমি বললাম আমীন। যখন তৃতীয় সিঁড়িতে পারাখলাম, তখন বললেন, ধ্বংস হোক ঐ ব্যক্তি যে বৃদ্ধ পিতা-মাতা উভয়কে অথবাএকজনকে পেল অথচ তারা উভয়ে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারল না। অর্থাৎতাদের খেদমতের মাধ্যমে নিজেকে জান্নাতবাসী করতে পারল না। আমি বললাম,আমীন। মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস - ৭৩৩৮, মাযমাউয যাওয়াইদ, হাদীস-১৭৩১৭

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকেও এ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। দেখুন : আলআদাবুলমুফরাদ, হাদীস ৬৪৬, মুসনাদে আহমদ, হাদীস-৭৪৫১, সহীহ ইবনে খুযায়মা,হাদীস-১৮৮৮, সুনানে তিরমিযী, হাদীস-৩৫৪৫, সহীহ মুসলিম, হাদীস-২৫৫১

হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন,

أول ما يصيب صاحب رمضان الذي يحسن قيامه وصيامه أن يفرغ منه وهو كيوم ولدته من الذنوب.

রমযান মাস লাভকারী ব্যক্তি-যে উত্তমরূপে সিয়াম ও কিয়াম (রোযা, তারাবী ও অন্যান্যআমল) পালন করে-তার প্রথম পুরস্কার এই যে, সে রমযান শেষে গুনাহ থেকে ঐদিনের মতো পবিত্র হয় যেদিন মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল।-মুসান্নাফে ইবনেআবি শায়বা, হাদীস-৮৯৬৬

৯. লাইলাতুল কদরের মাস

আল্লাহ রাববুল আলামীনের পক্ষ হতে মুসলিম উম্মাহর জন্য আরেকটি বিশেষ দান হলএক হাজার রাত অপেক্ষা উত্তম লাইলাতুল কদর। এই রাত এত মর্যাদাশীল ওবৈশিষ্ট্যপূর্ণ যে, এক হাজার রাত ইবাদত করলে যে সওয়াব হতে পারে, এই এক রাতেরইবাদতে তার চেয়েও বেশি সওয়াব পাওয়া যায়।

আল্লাহ তাআলা এ রাত সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন-

لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ  تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ  سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ

 (তরজমা) লাইলাতুল কদর এক হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ রাতে ফেরেশতাগণ ওরূহ (জিব্রীল আ.) তাদের পালনকর্তার আদেশক্রমে প্রত্যেক কল্যাণময় বস্ত্ত নিয়েপৃথিবীতে অবতরন করেন। যে রাত পুরোটাই শান্তি, যা ফযর হওয়া পর্যন্ত অব্যাহতথাকে।-সূরা কদর (৯৭) : ৩-৫

এই রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হওয়া চরম দুর্ভাগ্যের বিষয়।

হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. বর্ণনা করেন-

دخل رمضان، فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم : إن هذا الشهر قد حضركم، وفيه ليلة خير من ألف شهر،من حرمها فقد حرم الخير كله، ولا يحرم خيرها إلا محروم.

قال المنذري : إسناده حسن، إن شاء الله، وكذا قاله البوصيري.

রমযান মাসের আগমন ঘটলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরউদ্দেশে বললেন, তোমাদের নিকট এই মাস সমাগত হয়েছে, তাতে এমন একটি রাতরয়েছে, যা এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাতের কল্যান থেকে বঞ্চিতহল, সে প্রকৃতপক্ষে সকল কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত। একমাত্র (সর্বহারা) দুর্ভাগাই এরাতের কল্যান থেকে বঞ্চিত হয়।-সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস-১৬৪৪

তাই প্রত্যেক মুসলমানের উচিত, ইবাদত-বন্দেগী, যিকির-আযকার, তাসবীহ-তাহলীলও অন্যান্য নেক আমলের মাধ্যমে এ রাতের খায়ের-বরকত লাভে সচেষ্ট থাকা।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন। আমীন।